‘বস্ত্র ধৌতকরণ’ পরিবারের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার একটা উল্লেখযোগ্য দিক। কেননা প্রতিদিনই ব্যবহার্য কাপড় পরিষ্কার করতে হয়। আবার কখনো কখনো সাপ্তাহিক কিংবা মৌসুম ভিত্তিক ধৌতকরণ প্রক্রিয়া চলে। কাপড় ধোয়া পরিশ্রমের কাজ। এই কাজটি সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। যেমন,:
ময়লা কাপড় বাছাই করা
পরিষ্কার করার সুবিধার জন্য ময়লার তারতম্য অনুসারে জামাকাপড়, বিছানার চাদর, ছোট কাপড় ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ করে নিলে সুবিধা হয় ৷ নিত্যব্যবহার্য কাপড়,
আবার বিভিন্ন ধরনের তন্তুর কাপড়ে (যেমন, সুতি, লিনেন, রেশম, নাইলন, টেট্রন ইত্যাদি) একই পরিষ্কারক দ্রব্য বা ধৌতকরণ পদ্ধতি প্রযোজ্য নয়। বাছাইকরণের সময় যেসব কাপড়ের প্রকৃতি এবং ধোয়ার পদ্ধতি একই রকম সেগুলো সব এক সাথে রাখা উচিত। কাজেই বস্ত্ৰ ধৌতকরণের পূর্বে তন্তু, রং, আকার ও ময়লা অনুযায়ী বত্র বাছাই করতে হবে। কাপড়ে বা পোশাকের গায়ে যদি কোনো নির্দেশনা থাকে তবে তা অনুসরণ করা উচিত।
মেরামত করা—
ধৌত করার পূর্বে পোশাকের বা বস্ত্রের প্রয়োজনীয় মেরামত করে নিতে হয়। কাপড়ের কোনো অংশে ছেঁড়া থাকলে তা রিফু বা তালি দিয়ে ঠিক করে নিতে হয়। তা না হলে ধৌত করার সময় আরও বেশি ছিঁড়ে যেতে পারে। এই ছেঁড়া বড় হলে পোশাক পরার অযোগ্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বোতাম, হুক, বকলেস ইত্যাদি ঢিলা কি না পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কোনো অলংকারিক বোতাম, ক্লিপ থাকলে তা খুলে রাখতে হবে।
মেরামতের নমুনা
ক) রিফু করা : পোশাকের কোনো স্থানে খোঁচা লেগে ছিঁড়ে গেলে বা ফেঁসে গেলে ছেঁড়া স্থানের পড়েন সুতা সূক্ষ্ম ও নিপুণভাবে সুচের সাহায্যে ভরে দেওয়াকে রিফু বলা হয়। এজন্য বস্ত্রের সুতা অনুযায়ী সুচ ও সুতার প্রয়োজন। তা ছাড়া রিফু করার সুতা ও কাপড়ের রং এক হতে হয়। রিফু করার সময় ছেঁড়া অংশের চারদিকে প্রথমে পেনসিলের দাগ দিয়ে নিতে হয়। দাগের উপর দিয়ে ছোট করে রান ফোঁড় দিয়ে সেলাই করলে কাপড়ের সুতা খুলে আসবে না। এরপর এক একটি সুতার ভেতর দিয়ে সুচ দিয়ে প্ৰথমে টানা সুতার (Warp yarn) অংশ পরিপূরণ করতে হয়। ছেঁড়া অংশের সম্পূর্ণটা টানা সুতায় ভরে তুলে একই পদ্ধতিতে ভরা সুতার (Filling yarn) অংশের একটা সুতার উপর ও নিচ দিয়ে সেলাই করে পূরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে ফ্রেম ব্যবহার করলে সুবিধা হয়।
খ) তালি দেওয়া : বস্ত্র ও পোশাকের কোনো অংশ ছিঁড়ে গেলে এক পরতা কাপড়ের উপর আরেক পরতা কাপড় রেখে সেলাই করে আটকানোকেই তালি দেওয়া বলা হয়। পোশাক পরিচ্ছেদের কোনো অংশ ছিদ হলে, পুড়ে গেলে বা পোকায় কাটলে তালি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। তালি দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা-
(i) সাধারণ তালি : তালি গোলাকার বা চারকোনাকার হতে পারে। যে কাপড়ে তালি দেওয়া হবে তার অনুরূপ রং ও জমিনের বড় একখণ্ড কাপড় নিতে হবে। তালির কাপড় ছেঁড়া অংশ অপেক্ষা বড় হবে। টুকরা কাপড়টি তালি দেওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে ইস্ত্রি করে নিতে হয়। যে কাপড়টি দিয়ে তালি দিতে হবে সে কাপড়ের টুকরা ছেঁড়া জায়গায় বসিয়ে ধার মুড়ে চারদিকে হেম ফোঁড় দিয়ে কাপড়ের সাথে আটকাতে হবে। এবার কাপড়টাকে উল্টো করে ছেঁড়া জায়গাটা কোনাকুনি কেটে মুড়ে টুকরা কাপড়ের সাথে হেম ফোঁড় দিয়ে সেলাই করে দুই পাশে ইস্ত্রি করে বসাতে হবে।
(ii) নকশা তালি : সাধারণ তালির জন্য কাপড়ের রঙের তালির কাপড় পাওয়া না গেলে অথবা তালি দিলে দেখতে খারাপ লাগবে মনে হলে অথবা ব্যবহৃত কাপড়টি এতই নতুন যে সৌন্দর্য নষ্ট করতে মন চাচ্ছে না, এখনো অনেক দিন ব্যবহার করতে হবে— এমন অবস্থায় নকশা তালির মাধ্যমে মেরামত করা যায় ৷ এক্ষেত্রে ছেড়া কাপড়ের উপর অন্য রঙের কাপড় দিয়ে নকশা করে কেটে প্রথমে টাক দিয়ে আটকিয়ে পরে বোতাম ফোঁড় দিয়ে সেলাই করতে হবে। উল্টা দিকের ছেঁড়া কাপড় সাধারণ তালির মতো সেলাই করতে হবে। যাতে সুতা বের হতে না পারে। এই নকশা তালির মতো আরও নকশা করে সমস্ত কাপড়ে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আরও নকশা বসিয়ে নিলে তালি দেওয়ার ব্যাপারটি বোঝা যায় না। অনেকটা এপ্লিক নকশার মতো দেখায়। ছেলেদের প্যান্ট, শিশুদের জামায় নকশা তালি হিসেবে বড় স্টিকার ব্যবহার করা যায় ৷
দাগ অপসারণ— নানা কারণে জামাকাপড়ে দাগ লাগে এবং ব্যবহারের অনুপযোগি হয়। দেখতেও খারাপ লাগে। তাই সম্পূর্ণ কাপড়টি ধোয়ার আগে দাগযুক্ত স্থানটির দাগের উৎস, তন্তুর প্রকৃতি জানতে হবে। কেননা রং অন্যান্য পরিস্কারক দ্রব্যের সংস্পর্শে এসে দাগটি স্থায়ীভাবে বসে যেতে পারে।
বস্ত্র পরিষ্কারক উপকরণ নির্বাচন— বস্ত্র ধৌতকরণের আগেই বস্ত্রের তন্তুর প্রকৃতি, ময়লার ধরন, রং, আকার-আয়তন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে উপযুক্ত পরিষ্কারক দ্রব্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। বস্ত্ৰ অনুযায়ী গরম বা ঈষদুষ্ণ পানি কিংবা ঠান্ডা পানি ব্যবহার করা হয়। আবার কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির জন্য নীল, মাড় ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। যেমন: সুতি ও লিনেন কাপড়ে সাধারণ সাবান ও ঠান্ডা পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। কিন্তু রেশমি ও পশমি বস্ত্র ডিটারজেন্ট পাউডার এবং ঈষদুষ্ণ পানি দিয়ে ধুতে হয়। সাবান মাখানোর পর প্রায় আধঘণ্টার মতো রেখে দিলে কাপড়ের ময়লা আলগা হয় এবং কাপড় ভালো পরিষ্কার হয়।
পানিতে ভেজানো— বেশি ময়লা কাপড় (মশারি, পর্দা, টেবিল ক্লথ ইত্যাদি) সাবান পানিতে দেওয়ার আগে ঠান্ডা বা ঈষদুষ্ণ পানিতে আধঘণ্টা বা একঘণ্টা ভিজিয়ে রাখলে কাপড়ের ময়লা আলগা হয়। এরপর সাবান পানি দিয়ে ধুলে কাপড় ভালো পরিষ্কার হয় এবং সাবানও কম খরচ হয়।
কাপড় কাচা— সাবান দিয়ে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখার পর জামাকাপড়ের বেশি ময়লা অংশগুলো ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। শার্টের কলার, হাতা, কাফ, প্যান্টের পেছনের অংশ, পাজামা-পেটিকোটের ঝুলের প্রান্ত প্রভৃতি স্থান বেশি ময়লা হয়। এ জন্য সম্পূর্ণ কাপড়টি কাচার আগে এই অংশগুলো একটু বেশি করে সাবান দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। প্রয়োজনে নরম ব্রাশ ব্যবহার করা যায়। এরপর সম্পূর্ণ কাপড় অল্প অল্প পানি দিয়ে থুপে থুপে ধুতে হয়। তবে রেশমি কাপড় না কেচে দুহাতে চাপ দিয়ে ধুতে হয়- রগড়ানো ঠিক নয়। এতে কাপড়ের কোমল আঁশের ক্ষতি হয়।
প্রক্ষালন— কাপড়ের ময়লা পরিষ্কার করার পর বড় বালতি বা গামলায় বেশি করে পানি নিয়ে কাপড় বারবার ধুয়ে ময়লা ও সাবান ছাড়াতে হয়। ময়লা ও সাবান ছাড়ানোর জন্য বারবার পানি বদলানোর প্রক্রিয়াকেই প্রক্ষালন বলা হয় ।
এরপর কাপড় নিংড়ে পানি বের করতে হয়। রেশমি কাপড়ের পানি নিংড়ানোর সময় না মুচড়িয়ে চেপে চেপে পানি বের করতে হয়। ধোয়া পশমি কাপড় মোটা তোয়ালের মধ্যে জড়িয়ে চাপ দিয়ে পানি শোষণ করাতে হবে। রেশমি ও পশমি কাপড় শেষবার ধোয়ার সময় পানিতে সামান্য পরিমাণ ভিনিগার মিশিয়ে নিলে কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।
নীল ও মাড় প্রয়োগ— সাধারণত সুতি ও লিনেনের কাপড়ে মাড় দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কতোটা ঘন মাড় দেওয়া হবে তা নির্ভর করে কাপড়ের প্রকৃতির উপর। মোটা কাপড়ে পাতলা মাড় দেওয়া হয়। সাদা কাপড়ে নীল প্রয়োগ করা হয়। যখন কাপড়ে নীল ও মাড় দেওয়ার প্রয়োজন হয় তখন মাড়ের মতো নীল গুলে নেওয়া হয়। ধোয়া কাপড় নীল মেশানো মাড়ে ডুবিয়ে নিংড়ে নিয়ে রোদে শুকাতে হয়। এভাবে সুতি সাদা কাপড় এবং গাঢ় রঙের (নীল/কাল) কাপড়ের উজ্জ্বলতা বাড়ে।
কাপড় শুকানো— কাপড় ধোয়ার পর ঠিকভাবে না শুকালে কাপড়ের ধবধবে এবং কড়কড়ে ভাবটা আসে না। মেটমেটে ভাব এবং স্যাঁতসেঁতে গন্ধ হতে পারে। সাদা কাপড় রোদে শুকালে আরও সাদা হয়ে উঠে। রঙিন কাপড়, রেশমি কাপড় ছায়ায় শুকানো ভালো। পশমি কাপড় বাতাসপূর্ণ খোলামেলা ছায়াযুক্ত কোনো সমতল জায়গায় বিছিয়ে শুকাতে হয়। কাপড় বা পোশাকের ভারী মজবুত অংশ উপরের দিকে রেখে শুকাতে দিতে হয় । ইস্ত্রি করা— ধোয়ার পর প্রায় সব কাপড়েই কুঞ্চন সৃষ্টি হয়। কাপড় মসৃণ ও পরিপাটি করার জন্য ইস্ত্রি করা হয়। ইস্ত্রি করার আগে মাড় দেওয়া সুতি কাপড়গুলো সামান্য পানি ছিটিয়ে নরম করে নিতে হয়। কাপড়ের প্রকৃতি অনুসারে ইস্ত্রির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন : রেশম ও কৃত্রিম তন্তুর কাপড় সর্বনিম্ন তাপে, পশম ৩০০°F তাপে, সুতি ৪০০-৪৫০°F তাপে, লিনেন ৪৭৫°-৫০০°F তাপে ইস্ত্রি করা হয়।
হাওয়া লাগানো— ইস্ত্রি করার পর বস্ত্রাদিতে আর্দ্রভাব থাকে। এই অবস্থায় বক্স বা আলমারিতে রাখা ঠিক নয়। সেজন্য কিছুক্ষণ খোলা বাতাসে রেখে আর্দ্রভাব দূর করতে হয়। কাপড় শুকালে যথাস্থানে সংরক্ষণ করতে হয়।
আরও দেখুন...